Published December 10, 2022 | Version pdf
Book Open

জিহাদ, যুদ্ধ ও কিতাল: একমাত্র পবিত্র কোরআনের আলোকে (Jihad, War and Kital: In the Light of the Holy Qur'an)

Description

পটভূমি

জিহাদ (الجهاد), যুদ্ধ (حرب) ও কিতাল (قتل) এই তিনটি শব্দ পবিত্র কোরআনে অনেক বার এসেছে। এই তিনটি শব্দের মধ্যে জিহাদ (الجهاد) ও কিতাল (قتل) দুটি শব্দ সালাতের সাথে গুরুত্ত্বপূর্ণ চলক হিসাবে রয়েছে বলেই এই গবেষণা। সালাতের সাথে জিহাদ শব্দটি একটি আয়াত    "আর তোমরা আল্লাহর পথে জিহাদ কর যেভাবে জিহাদ করা উচিৎ।......"[1] সালাতের সাথে সরাসরি তিনটি আয়াতে দেখা যায় যে, কিতালকে ফরজ হিসাবে দেখা যায়[2], রয়েছে মুশরিকদের সাথে কিতাল কৌশলও[3]  এবং কেউ কেউ আল্লাহর পথে লড়াই করবে[4] এই ভাবে। এই তিনটি শব্দের অনুবাদ ও গবেষণা পর্যালোচনা করে যতটুকু বুঝা গেল তা হচ্ছে যে, পবিত্র কোরআন একটি স্বতন্ত্র এবং উন্নত মানের ভাষায় রচিত, যা প্রচলিত আরবি ভাষা ও ব্যাকরণ দিয়ে বুঝতে অনেক ক্ষেত্রেই রয়েছে অপরিপক্কতা। তাই যেমনটি দেখা যায় সর্বনামের ক্ষেত্রে তেমনটি এই তিনটি শব্দের ক্ষেত্রে জিহাদ (الجهاد), যুদ্ধ (حرب) ও কিতাল (قتل) অনেকটাই এখনও একদিকে যেমন অস্পষ্ট অন্যদিকে নিজ নিজ মাজহাব ঠিক রাখতে গিয়ে রয়েছে অনেক অপব্যাখ্যা।

এমনকি অনুবাদকগণ কিতাল এবং যুদ্ধকে অনেক যায়গায় জিহাদ হিসাবেও অনুবাদ করেছেন। তাই বর্তমান বিশ্বে জিহাদকে মানুষকে হত্যা ও ধ্বংসের পরিভাষায় মনে করা হয়। যা প্রকৃত পক্ষে পবিত্র কোরআনে যে সকল আয়াত গুলিতে জিহাদ (الجهاد) শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। এমনকি জিহাদ (الجهاد), যুদ্ধ (حرب) ও কিতাল (قتل) কোন একটি আয়াতে একসাথেও ব্যবহার করা হয় নি। তাই পবিত্র কোরআন সঠিক ভাবে বুঝতে হলে আমাদের একমাত্র পবিত্র কোরআন দিয়েই সকল কিছু বুঝতে হবে কারণ আল্লাহ বলে দিয়েছেন "অতঃপর এর বিশদ ব্যাখ্যার দায়িত্ব আমারই।"[5] আমরা এই নীতি থেকে অনেক দূরে যেতে যেতে আজ মনে হচ্ছে পবিত্র কোরআন আমাদের জীবনের কোথাও নেই। আমাদের জীবনের সকল স্তরকে ঘিরে ফেলেছে আহলে কিতাবীদের গ্রন্থের ইবাদত এবং জীবন বিধান।

পবিত্র কোরানে জিহাদ (الجهاد) যে সকল আয়াতে ব্যবহার করা হয়েছে আল্লাহ ও পরকালের প্রতি দৃঢ় ঈমান রেখে নিজের জান-মাল দিয়ে আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করতে বলা হয়েছে। এর অর্থ কি কাউকে হত্যা বা খুন করতে বলেছেন, অবশ্যই না। বলেছেন আর তোমরা আল্লাহর পথে জিহাদ কর যেভাবে জিহাদ করা উচিৎ।[6] কিভাবে? "সুতরাং তুমি কাফিরদের আনুগত্য করো না এবং তুমি কুরআনের সাহায্যে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর জিহাদ কর।"[7] পরিষ্কার ভাবেই বলেছেন কোন কাফেরের সাথে এখানে পবিত্র কোরআন ব্যবহার করতে বলা হয়েছে। তা ব্যবহার করতে হলে অবশ্যই আমাদের পবিত্র কোরআন সম্পর্কে যথাযথ জ্ঞান দরকার। যদি তা থাকে আল্লাহ বলেই দিয়েছেন অবশ্যই তারা পিঠ দেখিয়ে পালাবে[8] কার বিরুদ্ধে? প্রথমত নিজের পিতা-মাতার বিরুদ্ধেই[9] অর্থাৎ শুধুমাত্র তাদের এই ধরণের আদেশ অমান্য করতে হবে। তাদের হত্যা বা খুনতো দূরের কথা খারাপ ব্যবহারও করা যাবে না। দ্বিতীয়ত কাফির ও মুনাফিকদের বিরুদ্ধে, অস্ত্র কি? জিহাদ স্তরে অর্থাৎ জিহাদ শব্দ ব্যবহৃত আয়াতে কোথাও পবিত্র কোরআন ছাড়া কোন দ্বিতীয় অস্ত্র ব্যবহারের কথা নেই। বর্তমান সমাজ ও রাষ্ট্রে এই একটি মাত্র অস্ত্র প্রয়োগ করলেই জান-মাল সহ বাকি যে সকল উপকরণের মায়ার কথা আল্লাহ বলেছেন তা সবই চলে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।

পবিত্র কোরানে জিহাদের আয়াত সমূহে আমাদের পরিষ্কার করে দিয়েছেন যে  জিহাদ স্তর হচ্ছে হচ্ছে নিজের কুরিপু ও সমাজের সাথে কঠোর সংগ্রাম করা, যার একমাত্র অস্ত্র ও নির্দেশিকা হচ্ছে পবিত্র কোরআন এবং আল্লাহ আমাদের বেহেস্তে প্রবেশের জন্য ইহাকে পরীক্ষা হিসাবে উল্লেখ করেছেন। এই পরীক্ষায় উত্তীর্ন হতে হলে আমাদের অন্তর এবং কর্মকে একমাত্র আল্লাহর যাবতীয় বিধিবিধান অনুসরণ করতে হবে। কেবলমাত্র এই স্তরে উন্নীত মুসলিমদের জন্য কিতাল (قتل) ফরজ করা হয়েছে। তাই জিহাদকে কিতাল ও যুদ্ধ হিসাবে যারা উল্লেখ করে নানা ধরণের বিশৃঙ্খলা করে যাচ্ছেন, তাদের পবিত্র কোরআন আরো গভীরভাবে অধ্যায়ন করা উচিৎ।

যুদ্ধ (حرب) ও কিতাল (قتل) আদিমকাল থেকে আধুনিক বিশ্বের একটি গুরুত্ত্বপূর্ন বিষয়। আদিমকালে মানুষকে বেঁচে থাকতে হলে নানা ধরণের হিংস্র জন্তু-জানোয়ারের সাথে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করেই বেঁচে থাকতে হত। সভ্যতা বিকাশের সাথে সাথে ঐ সকল হিংস্র জন্তু-জানোয়ারের জন্য নিরাপদ বিচরণের যায়গা চিহ্নিতকরণের পাশাপাশি মানুষ তার নিজের জন্য নিরাপদ আবাসস্থল তৈরি করে নিয়েছে সত্যি। কিন্ত দেখা গেল যে মানুষের হিংস্রতা অনেক ক্ষেত্রেই পশুকেই ছাড়িয়ে গেল এবং যাচ্ছে। তাই প্রত্যেকটি পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র এই সকল মানুষ রূপী হিংস্র প্রাণী থেকে বেঁচে থাকতে ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে একদিকে যেমন নিরাপত্তার ব্যবস্থা করে রাখেন অন্য দিকে আক্রমণ হলে যুদ্ধে জয়লাভের যাবতীয় ব্যবস্থা করে রাখেন। সর্বোপরি লড়াই ও যুদ্ধ বেঁধে গেলে কিভাবে করতে হবে এবং এর পরবর্তী বিধিবিধান কি হবে তাও আধুনিক বিশ্বে সকল ছোট বড় রাষ্ট্রেই রয়েছে। আর মহান আল্লাহ এই সকল ক্ষেত্রে তার কৌশল, সহযোগিতা এবং মানুষের ক্ষেত্রে সকল প্রকার বিধিবিধান লিপিবদ্ধ করে দিয়েছেন এবং আমাদের জন্য ফরজ করে দিয়েছেন। আধুনিক বিশ্বে কিছু দেশ তার সকল জনগণকে বাধ্যতামূলক সামরিক ট্রেনিং দিয়েও থাকেন, যেন রাষ্ট্রের প্রয়োজনে সকলেই অংশগ্রহণ করতে পারেন।

তাই যুদ্ধ নতুন কিছু নয়, পবিত্র কোরআন অনুসারীদের জন্য এ ধরণের যুদ্ধের কারণ, প্রক্রিয়া, বিধিবিধান, নিয়মনীতি, সন্ধি ও যুদ্ধ পরবর্তী অবস্থা বর্ণনা করেছেন তা সভ্য জগতে আমাদের চোখের সামনে যা ঘটছে তার চেয়ে অনেক বেশি মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকেই সাঝিয়ে দিয়েছেন বলে-ই মনে হয়। পবিত্র কোরআন কখনও কাউকে জোরপূর্বক ইসলামের দিকে আহবান করে না বরং অন্যের ধর্মকে মর্যাদা দিয়ে পরকালে আল্লাহর বিচারের অপেক্ষায় থাকে। কিন্তু কোন কর্তৃপক্ষ যদি মুসলিম হওয়ার কারণে নির্যাতন করে, তাহলে পবিত্র কোরআনের বিধিবিধান মেনে যুদ্ধ করবে এটাই আল্লাহর বিধান। এই বিধান নতুন নয়। আল্লাহ মানুষের জন্য এই বিধান সৃষ্টির শুরু থেকেই বহাল রেখেছেন। এই সংকলনে শুধুমাত্র পবিত্র কোরআনে  জিহাদ (الجهاد), যুদ্ধ (حرب) ও কিতাল (قتل) সম্পর্কে যে সকল আয়াতগুলি রয়েছে তা ব্যস্ত পাঠকের জন্য সাঝিয়ে দেয়া হয়েছে, যেন এই সম্পর্কে সহজেই জ্ঞান লাভ করতে পারেন।

দুটি অধ্যায়ে ভাগ করা হয়েছে, প্রথম অধ্যায়ে রয়েছে জিহাদ (الجهاد) এবং দ্বিতীয় অধ্যায়ে রয়েছে যুদ্ধ (حرب) ও কিতাল (قتل) সম্পর্কিত আয়াত সমূহ। এখানে তিনটি বাংলা অনুবাদ দেয়া হয়েছে, যদিও এর চেয়ে কাছাকাছি অনুবাদ এই মুহূর্তে হাতের কাছে নেই এবং একটি ইংরেজি অনুবাদ। তিনটি অনুবাদের যুক্তি হচ্ছে পাঠক যেন একটু নিজের বিবেক-বুদ্ধি দিয়ে বুঝতে পারেন যে, এখনও পবিত্র কোরআনের সঠিক অনুবাদে যথেষ্ট ত্রুটি রয়েছে।  অনুবাদের উপরে আরবি লেখায় তিনটি শব্দের অনুবাদগুলি বিভিন্ন যায়গায় একটু গভীর ভাবে পর্যবেক্ষণ করলে সহজেই বুঝা যাবে যে, অনুবাদকের নিজস্ব অনুভূতি কোনভাবেই নিরপেক্ষতা নেই। যেখানে পবিত্র কোরআনের অনুবাদের ক্ষেত্রে এই ধরণের গরমিল সেখানে জিহাদকে যুদ্ধ ও কিতাল হিসাবে মানুষের কাছে উপস্থাপন করে যারা বই রচনা করেছেন বিভিন্ন আহলে কিতাবের রেফারেন্স দিয়ে তা কতটুকু কোরআন সমর্থন করে, তা আয়াতগুলি গভীর মনোযোগ দিয়ে অধ্যায়ন করলেই বুঝা যাবে।

এখানে উল্লেখ যে, এই সংকলনে কেবলমাত্র জিহাদ (الجهاد), যুদ্ধ (حرب) ও কিতাল (قتل) সংশ্লিষ্ট আয়াতগুলি তুলে ধরা হয়েছে, যদিও কিছু ক্ষেত্রে আয়াতগুলির সামনে ও পিছনের কিছু আয়াত দেয়া হয়েছে, যেন পাঠক বিষয়বস্তু সহজেই অনুধাবন করতে পারেন। তবে বিস্তারিত বুঝতে হলে সংশ্লিষ্ট সূরা এবং বিশেষ ক্ষেত্রে বর্ণনা শুরু থেকে পড়লে গভীর ভাবে বুঝতে পারবেন। তাছাড়া এখানে বিষয়বস্তু সাঁজাতে গিয়ে কিছু ক্ষেত্রে একই বিষয়ে অন্য আয়াতেও দেখা যাবে কারণ কোন একটি আয়াতের অংশবিশেষ এখানে তুলে ধরা হয় নি। প্রতিটি ক্ষেত্রেই রয়েছে সম্পূর্ণ আয়াতটি। গভীর অধ্যায়নের জন্য অবশ্যই পবিত্র কোরআনে ধারাবাহিক ভাবে পড়ার অনুরোধ রইল।

 

ড. কাজী আব্দুল মান্নান

 

[1] (২২:৭৮) সূরাঃ আল-হজ্জ, আয়াত:৭৮

[2] (৪:৭৭) সূরাঃআন-নিসা, আয়াত:৭৭

[3] (৯:৫) সূরাঃআত-তাওবা, আয়াত:৫

[4] (৭৩:২০) সূরাঃ আল-মুযযাম্মিল, আয়াত:২০

[5] (৭৫:১৯) সূরাঃআল-ক্বিয়ামাহ, আয়াত:১৯

[6] (২২:৭৮) সূরাঃ আল-হজ্জ, আয়াত:৭৮

[7] (২৫:৫২) সূরাঃআল-ফুরকান, আয়াত:৫২

[8] (৪৮:২২) সূরাঃআল-ফাতহ , আয়াত:২২

[9] (২৯:৮)সূরাঃআল-আনকাবূত, আয়াত:৮

Files

জিহাদ (الجهاد), যুদ্ধ (حرب) ও কিতাল (قتل)-Online Version.pdf